Defects of the Price Mechanism
বাজারে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া চাহিদা ও যোগানের ঘাত-প্রতিঘাতে বিভিন্ন দ্রব্য ও সেবার এবং উৎপাদনের উপাদানসমূহের দাম নির্ধারিত হয়ে যে ব্যবস্থার উদ্ভব হয়, তাকে বলে দামব্যবস্থা। (Defects of the Price Mechanism)
ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় অর্থনীতির মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধান করে সম্পদসমূহের বণ্টনের ব্যবস্থা করে দামব্যবস্থা। দামব্যবস্থায় দুর্লভ অর্থনৈতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার হয় বলে দাবি করা হয়ে থাকে। আবার অর্থনৈতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার হয় বলেই সামাজিক দক্ষতা অর্জন সম্ভব হয় এবং সামাজিক কল্যাণও সর্বাধিক হয় বলে দাবি করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এমন কতকগুলি অবস্থার সৃষ্টি হয়, যাতে দামব্যবস্থায় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় এবং দুর্লভ অর্থনৈতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার সম্ভব হয় না। এই পরিস্থিতিকেই বলা হয় দামব্যবস্থার বা বাজারব্যবস্থার ব্যর্থতা বা দামব্যবস্থার ত্রু ত্রুটি। দামব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটিগুলি উল্লেখ করা হল।
(১) সরকারী দ্রব্যের উপস্থিতি (Existence of Public Goods) :
বাস্তবে এমন কতকগুলি দ্রব্য আছে। যেগুলি শুধুমাত্র একজনকে সরবরাহ করা সম্ভব নয়। তাই একজনকে সরবরাহ করতে হলে সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদেরও সরবরাহ করতে হয়। এই সমস্ত দ্রব্যকেই বলা হয় সরকারী দ্রব্য। সরকারী দ্রব্যের উদাহরণ হল প্রতিরক্ষা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, রাস্তা আলোকিতকরণ ইত্যাদি। এই সমস্ত দ্রব্যের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যক্তি এই সমস্ত দ্রব্যের সুবিধা ভোগ করলেও অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রয়োজন হয় না। তাই দামব্যবস্থার মাধ্যমে এই সমস্ত দ্রব্য সরবরাহ সম্ভব হয় না। সেই জন্যই বলা যায় সরকারী দ্রব্যের উপস্থিতি দামব্যবস্থার একটি ব্যর্থতা।
(২) বাহ্যিকতার উপস্থিতি (Existence of Externalities) :
বাজার ব্যবস্থায় আবার বাহ্যিকতার সৃষ্টি হয়। কোনো ব্যক্তির অর্থনৈতিক কাজকর্মের দ্বারা অপর ব্যক্তির কাজকর্ম যখন প্রভাবিত হয়, যদিও প্রথম ব্যক্তির সাথে অন্য ব্যক্তির কাজকর্ম যুক্ত নয়, তখন তাকে বলে বাহ্যিকতা। বাহ্যিকতা দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি হল ধনাত্মক বাহ্যিকতা এবং অপরটি হল ঋণাত্মক বাহ্যিকতা। বাজার লেনদেনের ফলে ক্রেতা ও বিক্রেতা ছাড়া যদি কোনো তৃতীয় ব্যক্তি সুবিধা পেয়ে থাকেন তাহলে তাকে বলে ধনাত্মক বাহ্যিকতা।
যেমন পশ্চিমবঙ্গে হলদিয়ায় শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার ফলে ঐ অঞ্চলের জনসাধারণের রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ইত্যাদির সুবিধা ভোগ হল ধনাত্মক বাহ্যিকতা। আবার বাজার লেনদেনের ফলে ক্রেতা ও বিক্রেতা ছাড়া যদি কোনো তৃতীয় ব্যক্তি এই লেনদেনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তাকে বলে ঋণাত্মক বাহ্যিকতা। যেমন, হলদিয়া শিল্পাঞ্চলে পরিবেশের দূষণ। সরকারী নিয়ন্ত্রণের দাসব্যবস্থার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা যায় না।
(৩) স্বাভাবিক একচেটিয়ার উপস্থিতি (Existence of Natural Monopoly) :
আয়তনজনিত ব্যয়- সংক্ষেপ বা আয়তনজনিত ব্যয়-সংকোচের ফলে একটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে একক পিছু উৎপাদন ব্যয় যদি ক্রমশ কমতে থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানটি কিছুদিনের মধ্যেই সমগ্র বাজারে নিজের দখল প্রতিষ্ঠা করে স্বাভাবিক একচেটিয়ায় পরিণত হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে বাজারে কোনো প্রতিযোগিতা না থাকার ফলে প্রতিষ্ঠানটি নিজের ইচ্ছামত দাম ধার্য করে। এটিও দামব্যবস্থার একটি ব্যর্থতা।
(৪) উৎপাদনের ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব (Lack of Production Efficiency) :
বাজার ব্যবস্থায় উৎপাদক উৎপাদন ব্যয় কমাবার জন্য যে উপাদানের দাম কম তা বেশি পরিমাণে ব্যবহার করে। কিন্তু কম দামের উপাদান ব্যবহার হলেই যে উপাদানের সঠিক বণ্টন ও ব্যবহার হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেমন, ভারতের মতো দেশে শ্রমিকের যোগান বেশি হওয়ার জন্য মজুরির হার কম৷ ফলে কম মজুরিতে বেশি পরিমাণে শ্রমিক ব্যবহার করাই উচিত। কিন্তু কম মজুরিতে যে শ্রমিক পাওয়া যায়, তা সাধারণত অদক্ষ হয়। অদক্ষ শ্রমিকের দ্বারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে দক্ষতা বজায় রাখার বিষয়টি দামব্যবস্থার একটি সমস্যা।
(৫) অনুৎপাদক শ্রেণীর উপস্থিতি (Existence of Unproductive Group):
বাজার ব্যবস্থায় ফাটকা কারবারী, মহাজন, খাজনাভোগী জমির মালিক বাজারের অস্থিরতার সুযোগে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ উপার্জন করে থাকে। এই শ্রেণী উৎপাদনে তেমন ভূমিকা পালন না করেও যথেষ্ট প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এটি সুস্থতার লক্ষণ নয়। সুতরাং অনুৎপাদক শ্রেণীর উপস্থিতি দাম ব্যবস্থার আর এক ত্রুটি।
(৬) আয়বৈষম্য (Inequality of Income) :
বাজার ব্যবস্থায় ধনী ব্যক্তি আরও ধনী হয় এবং দরিদ্র ব্যক্তি আরও দরিদ্র হয়। কারণ বাজার ব্যবস্থায় মূলধনের মালিক বেশি অর্থ উপার্জন করে থাকে, অথচ শ্রমিক উৎপাদনে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়।
(৭) সামাজিক কল্যাণ অবহেলিত (Negligence of Social Welfare) :
বাজার ব্যবস্থায় অর্থই সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। উৎপাদক সেই সমস্ত দ্রব্যই উৎপাদন করে যাতে মুনাফা আছে। যে সমস্ত দ্রব্য উৎপাদনে মুনাফা নেই, সেগুলি সমাজের জন্য যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, তা উৎপাদকরা উৎপাদন করে না। অর্থাৎ বাজার ব্যবস্থায় সামাজিক কল্যাণের বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে অবহেলা করা হয়। এটিও বাজার ব্যবস্থার বা দাম ব্যবস্থার একটি ত্রুটি।
দামব্যবস্থার এই সমস্ত ত্রুটির জন্যই বর্তমানে কিন্তু অবাধ ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার দৃষ্টান্ত খুবই কম। এর পরিবর্তে অবস্থান করছে নিয়ন্ত্রিত ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা। ফলে দামব্যবস্থার কার্যকারিতাও কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তাই বর্তমানে দেখা যাচ্ছে উৎপাদকরা দ্রব্যের দামকে, শ্রমিক সংঘ মজুরিকে, মূলধনের মালিক সুদকে প্রভাবিত করছে। বর্তমানে সরকারও দাম নিয়ন্ত্রণ করে বরাদ্দের (rationing) ব্যবস্থা করছে। এই সমস্ত কারণে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাতেও দামব্যবস্থার কার্যকারিতা কিছুটা কমেছে। Defects of the Price Mechanism