Production and Cost
উৎপাদকের আচরণ ব্যাখ্যার দুটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল উৎপাদন ও ব্যয় (Production and Cost)। এই দুটি বিষয়ের বিভিন্ন দিক এই অধ্যায়ে আলোচনা করা হল।
উৎপাদন কথাটির অর্থ (Meaning of the term Production)
উৎপাদন কথাটির অর্থ বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। অধ্যাপক অ্যাডাম স্মিথের (Adam Smith) মতে, বস্তুগত দ্রব্য সৃষ্টিকে বলা হয় উৎপাদন। বস্তুগত দ্রব্য বলতে যে সমস্ত দ্রব্য স্পর্শ করা যায় তাদের বোঝায়। যেমন শ্রমিক দ্বারা চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি তৈরি হল বস্তুগত দ্রব্য সৃষ্টি, অর্থাৎ উৎপাদন। সুতরাং অ্যাডাম স্মিথের মতে, অবস্তুগত দ্রব্য সৃষ্টি, যেমন শিক্ষকের শিক্ষকতা, ডাক্তারের সেবা ইত্যাদি উৎপাদন নয়। অধ্যাপক মার্শালের (Marsha l) মতে, উপযোগ বা উপযোগিতা সৃষ্টি করাকে বলে উৎপাদন। সুতরাং মার্শালের যতে বস্তুগত দ্রব্য সৃষ্টি বা অবস্তুগত দ্রব্য সৃষ্টি উভয়ই হল উৎপাদন। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী শ্রমিক দ্বারা চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি তৈরিকে যেমন উৎপাদন বলা যায়, ঠিক একইভাবে প্রত্যক্ষ সেবা সৃষ্টি যেমন শিক্ষকের শিক্ষকতা, ডাক্তারের সেবা, অভিনেতার অভিনয় ইত্যাদি, অবস্তুগত দ্রব্য সৃষ্টিও হল উৎপাদন।
আধুনিক অর্থনীতিবিদদের মতে, যে কাজের দ্বারা বিক্রয়ের জন্য দ্রব্য ও সেবা সৃষ্টি করা হয়, তাকে বলে উৎপাদন। সুতরাং যে সমস্ত দ্রব্যের বিক্রয়যোগ্যতা আছে এবং বিনিময় মূল্য আছে, সেই সমস্ত দ্রব্য সৃষ্টি করাই হল উৎপাদন। অতএব যে সমস্ত দ্রব্য ও সেবার বিক্রয়যোগ্যতা নেই এবং বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করা যায় না, সেগুলি উৎপাদন নয়। যেমন মা-বোনের সেবা, গৃহস্থালীর কার্যকলাপ, বাড়ির বাগানে নিজ ভোগের জন্য সব্জি চাষ ইত্যাদি উৎপাদন নয়।
সুতরাং বাজারে বিক্রয়ের জন্য তৈরি দ্রব্য, যেমন ধান, চাল, গম, তৈলবীজ, সাবান, ভোজ্য তেল, টেলিভিশন, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সৃষ্টির কাজ হল উৎপাদন। অপরপক্ষে ডাক্তার, শিক্ষক, আইনজীবী, পরিবহন-কর্মী, ব্যবসায়ী, ট্রাফিক পুলিশ, পেশাদারী খেলোয়াড়, অভিনেতা, অফিস-কর্মচারী, ঝাড়ুদার প্রভৃতির সেবাকাজও হল উৎপাদন।
উৎপাদনের উপাদানসমূহ (Factors of Production)
কোনো দ্রব্য বা সেবাকার্য উৎপাদনের জন্য যা কিছু সহায়তা করে, তাদের বলে উৎপাদনের উপাদানসমূহ। আধুনিক অর্থনীতিবিদরা এদের উৎপাদনকারক বা ইনগুটস্ (Inputs) বলে থাকেন। অর্থনীতিতে উৎপাদনের উপাদানসমূহকে সাধারণত চারটি ভাগে ভাগ করা হয় জমি, শ্রম, মূলধন এবং সংগঠন। এই চারটি উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করা
জমি (Land)
সাধারণ অর্থে জমি বলতে মাটিকে বোঝায়। কিন্তু অর্থনীতিতে জমি কথাটি একটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতির যে সমস্ত দান উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা যায়, অর্থনীতিতে তাদের জমি বলা হয়। সুতরাং যে সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা যায়, সেই সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদই হল জমি। এই অর্থে ভূমি, খনি, বনভূমি, গোচারণ ভূমি, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, সূর্যালোক, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি জমির মধ্যে ধরা হয়। কিন্তু সংকীর্ণ অর্থে যে সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদে মানুষের নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা থাকে না, তাদের জমির মধ্যে ধরা হয় না। যেমন সূর্যালোক, বৃষ্টিপাত, বাতাস ইত্যাদি।
জমির বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Land)
উৎপাদনের উপাদান হিসাবে জমির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। বৈশিষ্ট্যগুলো নীচে উল্লেখ করা হচ্ছে :-
(ক) প্রকৃতির দান : জমি হল প্রকৃতির দান। মানুষ জমি সৃষ্টি করে না। সেইজন্য জমির কোনো উৎপাদন ব্যয় নেই।
(খ) জমির যোগান স্থির : জমির যোগান প্রকৃতির দ্বারা নির্ধারিত। জমির যোগান বাড়ানো সম্ভব নয়।সেইজন্য সমগ্র অর্থনীতির দিক থেকে জমির যোগান স্থির ও নির্দিষ্ট।
(গ) জমি বহু ধরনের হয়: জমি বিভিন্ন প্রকারের হয়। বিভিন্ন জমির উর্বরতা শক্তি ও অবস্থান বিভিন্ন প্রকারের। কোনো জমি বেশি উর্বর, আবার কোনো জমি কম উর্বর। অবস্থান অনুসারে জমির পার্থক্য ঘটে থাকে। যেমন গ্রামের জমি অপেক্ষা শহরের জমি অবস্থানগত কারণে বেশি মূল্যবান।
(ঘ) জমি স্থানান্তরযোগ্য নয়, কিন্তু জমির মালিকানা পরিবর্তনযোগ্য : জমি স্থানান্তর করা যায় না, অর্থাৎ জমিকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা যায় না। কিন্তু জমির মালিকানা বিক্রয়ের মাধ্যমে একজনের কাছ থেকে আর একজনের কাছে হস্তান্তর করা যায়।
(ঙ) জমিতে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদনের নিয়ম কাজ করে : জমিতে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদনের নিয়ম কাজ করে। এর অর্থ হল, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে শ্রম ও মূলধন যদি ক্রমাগত অধিক পরিমাণে নিয়োগ করা হয়, কিন্তু কৃষি পদ্ধতির কোনো পরিবর্তন না করা হয়, তাহলে শ্রম ও মূলধনের প্রান্তিক উৎপাদন একটি নির্দিষ্ট স্তরের পর কমতে থাকে। কৃষকের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এই নিয়মটি পাওয়া গেছে।
শ্রম (Labour)
শ্রম হল উৎপাদনের একটি মানবিক উপাদান। অর্থনীতিতে শ্রম বলতে শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রমকে বোঝায়। যেমন উৎপাদনে শ্রমিকের শ্রম হল শারীরিক শ্রম এবং উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের ইঞ্জিনিয়ারের শ্রম হল মানসিক শ্রম৷ আবার অর্থনীতিতে শ্রমের উদ্দেশ্য হল অর্থ উপার্জন। যে পরিশ্রমের সাথে অর্থ উপার্জনের সম্পর্ক নেই, তাকে অর্থনীতিতে শ্রম বলে না। যেমন মা যখন অসুস্থ সন্তানের সেবা করেন, তখন তিনি যে পরিশ্রম করেন, তাকে শ্রম বলা যায় না। কারণ, এই পরিশ্রমের উদ্দেশ্য অর্থ উপার্জন নয়। কিন্তু একজন নার্স যদি মায়ের ঐ একই অসুস্থ সন্তানের সেবা করেন, তাহলে নার্সের ঐ পরিশ্রমকে অর্থনীতিতে শ্রম বলা হয়। কারণ এই পরিশ্রমের উদ্দেশ্য হল অর্থ উপার্জন। সুতরাং উৎপাদন কাজে যদি শারীরিক ও মানসিক শ্রম নিযুক্ত হয় এবং তার বিনিময়ে যদি অর্থ উপার্জন করা হয়, তাহলে অর্থনীতিতে তাকে শ্রম বলে।