Real Cost of Production
প্রকৃত উৎপাদন ব্যয় (Real Cost of Production) : অধ্যাপক মার্শাল ও তাঁর অনুগামীরা উৎপাদন ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যয়ের ধারণা প্রবর্তন করেন (Real Cost of Production)। দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করার জন্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠান বা ফার্ম বিভিন্ন উপাদান নিয়োগ করে। এই সমস্ত উপাদানের মালিককে উপাদান যোগান দেওয়ার জন্য যে কষ্ট, বেদনা ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তাকেই বলে প্রকৃত উৎপাদন ব্যয়।
যেমন শ্রমিক যখন শ্রমের যোগান দেয়, তখন তাকে বিশ্রাম ত্যাগ করতে হয়। এই বিশ্রাম ত্যাগ করার জন্য শ্রমিককে যে কষ্ট স্বীকার করতে হয়, সেটাই হল শ্রমিকের প্রকৃত ব্যয়। উদ্যোক্তার কাজও হল একধরনের শ্রম। সুতরাং উদ্যোক্তারও প্রকৃত ব্যয় হল বিশ্রাম ত্যাগ করার জন্য উদ্যোক্তাকে যে কষ্ট স্বীকার করতে হয় সেটাই। আবার মূলধনের মালিক যখন মূলধনের যোগান দেয় তখন তাকে বর্তমান ভোগ থেকে বিরত থাকতে হয়। বর্তমান ভোগ থেকে বিরত থাকার জন্য মূলধনের মালিককে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয় সেটাই হল মূলধনের প্রকৃত ব্যয়। এই মতবাদ অনুসারে জমির কিন্তু কোনো প্রকৃত ব্যয় নাই। কারণ জমি প্রকৃতির দান বলে এটি
দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হলেও এর জন্য কোনো প্রকার ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন হয় না।প্রকৃত ব্যয়ের ধারণাটিকে কিন্তু বিভিন্ন দিক দিয়ে সমালোচনা করা যায়।
উল্লেখযোগ্য সমালোচনাগুলি হল:-
(১) পরিমাপযোগ্য নয় : এই মতবাদ অনুসারে উপাদানের মালিককে উপাদান যোগান দেওয়ার জন্য যে কষ্ট, বেদনা ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, সেটাই হল প্রকৃত ব্যয়। কিন্তু কষ্ট, বেদনা বা ত্যাগ সমস্ত কিছুই সম্পূর্ণ মানসিক অনুভূতির ব্যাপার, তাই এগুলি কোনো মতেই পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
(২) জমির খাজনার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে পারে না : এই মতবাদ অনুসারে জমির কোনো প্রকৃত ব্যয় নেই। সেই জন্যই জমি ব্যবহারের জন্য জমির মালিকের খাজনা এই মতবাদ ব্যাখ্যা করতে পারে না।
(৩) মূলধনের প্রকৃত ব্যয়ের হিসাব ত্রুটিপূর্ণ : এই মতবাদ স্বীকার করে মূলধনের মালিক যখন মূলধনের যোগান দেয় তখন তাকে বর্তমান ভোগ থেকে বিরত থাকতে হয়। এই ব্যাখ্যা কিন্তু সঠিক নয়। কারণ, সমাজের ধনী ব্যক্তিরাই বেশির ভাগ মূলধনের যোগান দেয়। কিন্তু ধনী ব্যক্তিরা যখন মূলধনের যোগান দেয় তখন তারা কিন্তু বর্তমান ভোগ থেকে বিরত থাকে না। আয়ের পরিমাণ বেশি থাকার জন্যই সঞ্চয়ের মাধ্যমে মূলধনের যোগান দিয়ে থাকে।
(৪) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি এবং মজুরি বৃদ্ধির সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারে না : এই মতবাদ অনুসারে শ্রমিক যখন শ্রমের যোগান দেয় তখন তাকে বিশ্রাম ত্যাগ করতে হয়। বিশ্রাম ত্যাগ করার জন্য শ্রমিকের যে কষ্ট স্বীকার করতে হয় সেটাই হল শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি। সুতরাং এই মতবাদ অনুসারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে কম পরিমাণ বিশ্রাম ত্যাগ করে বা খুব বেশি কষ্ট স্বীকার না করেই প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন সম্ভব হয় বলে মজুরিও কমতে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মজুরিও বাড়তে থাকে। সুতরাং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি ও মজুরি বৃদ্ধির সম্পর্ক এই মতবাদ ব্যাখ্যা করতে পারে না। এই সমস্ত সমালোচনার জন্য আধুনিক অর্থনীতিবিদরা এই মতবাদকে অবাস্তব ও অনিশ্চিত বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন। সেইজন্যই প্রকৃত ব্যয়ের ধারণাটি বর্তমানে আর খুব বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে না।
সুযোগ ব্যয় (Opportunity Cost) : অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদরা সুযোগ ব্যয়তত্ত্বের প্রবক্তা। অর্থনীতিতে উপাদানের যোগান সীমাবদ্ধ এবং উপাদানগুলি বিকল্প ব্যবহারের সুযোগ আছে। সুতরাং কোনো একটি দ্রব্য উৎপাদনে যখন উপাদানটি নিয়োগ করা হয় তখন অন্য কোনো ব্যবহারে উপাদানটির দ্বারা যা উৎপাদন করা যেত তা স্থগিত রাখতে হয়। ফলে একটি দ্রব্য উৎপাদন করলে অন্যান্য দ্রব্য উৎপাদনের সুযোগ সমাজকে ছেড়ে দিতে হয়। সুতরাং কোনো একটি দ্রব্য উৎপাদন করার জন্য অন্যান্য যে সমস্ত দ্রব্য উৎপাদন হওয়ার সুযোগ পেল না, তার পরিমাণই হল যে দ্রব্য উৎপাদন হল তার সুযোগ ব্যয়।
একটি কাল্পনিক উদাহরণের সাহায্যে সুযোগ ব্যয়ের ধারণা ব্যাখ্যা করা হল। ধরা যাক, এক চাষীর এক একর জমি আছে। এই জমিতে আলু ও সরিষা উভয় চাষই করা যায়। কিন্তু ঐ জমিতে আলু চাষ করলে সরিষার চাষ করা যাবে না। এখানে ধরা হচ্ছে চাষীর এক একর জমি আলু চাষে নিযুক্ত হল এবং আলু চাষের ফলে সরিষার চাষ করা হচ্ছে না। এখানে আরও ধরা হচ্ছে, ঐ এক একর জমি আলু চাষে নিযুক্ত হলে 10 কুইন্টাল আলু পাওয়া যায় এবং ঐ এক একর জমি আলু চাষ না করে সরিষা চাষে নিযুক্ত হলে 5 কুইন্টাল সরিষা পাওয়া যায়। আমাদের এই উদাহরণে 10 কুইন্টাল আলু পেতে হলে 5 কুইন্টাল সরিষা পাওয়ার সুযোগ ছাড়তে হয়। সুতরাং এখানে 10 কুহন্টাল আলুর সুযোগ ব্যয় হল 5 কুইন্টাল সরিষা। সুতরাং বলা যায় কোনো উপাদান সর্বোত্তম বিকল্প ব্যবহার (Next best alternative use) থেকে যা উপার্জন করতে পারতো, সেটাই হল ঐ উপাদানের সুযোগ ব্যয়।
সুযোগ ব্যয়ের ধারণা উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানের কাছে উপাদানের যোগান যেহেতু সীমিত তাই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হল সীমিত উপাদানের যথাযথ ব্যবহার। আমাদের উদাহরণে জমিটিতে আলু চাষ করলে জমিটি যথাযথ ব্যবহার হবে, না সরিষা চাষ করলে জমিটি যথাযথ ব্যবহার হবে, তা নির্ধারণের জন্য আলুর সুযোগ ব্যয় ও সরিষার সুযোগ ব্যয় অর্থের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হচ্ছে। ধরা যাক আলুর বাজার দাম হল 200 টাকা কুইন্টাল এবং সরিষার বাজার দাম হল 300 টাকা কুইন্টাল। সুতরাং জমিটিতে আলু চাষ করলে চাষী (200 টাকা x 10 কুইন্টাল) 2000 টাকার আলু পাবে। আবার জমিটিতে আলু চাষ না করে সরিষা চাষ করলে চাষী (300 টাকা x 5 কুইন্টাল) 1500 টাকার সরিষা পাবে। সুতরাং এখানে আলুর সুযোগ ব্যয় হল 1500 টাকা (সরিষার বিক্রয় মূল্য) এবং সরিষার সুযোগ ব্যয় হল 2000 টাকা (আলুর বিক্রয় মূল্য)।
সুতরাং জমিটিতে আলু চাষ করলে জমিটি যথাযথভাবে ব্যবহার হবে, কারণ যে দ্রব্য উৎপাদনের সুযোগ ব্যয় সব থেকে কম সেই দ্রব্য উৎপাদনে উপাদানটি নিযুক্ত হলে উপাদানটির যথাযথ ব্যবহার সম্ভব হয়। সুতরাং উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, যে দ্রব্য উৎপাদনে সুযোগ ব্যয় সব থেকে কম, সেই দ্রব্য উৎপাদনে উপাদানটি নিযুক্ত হলে উপাদানটির যথাযথ ব্যবহার সম্ভব হয় এবং উৎপাদকের মুনাফার পরিমাণও বেশি হয়। সুযোগ ব্যয়ের ধারণাটি অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলেও যে সমস্ত উপাদানের একটিমাত্র ব্যবহার আছে সেই সমস্ত উপাদানের ক্ষেত্রে সুযোগ ব্যয়ের ধারণা প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না (Real Cost of Production)।